চট্টগ্রাম আদালতে কাল্পনিক মামলায় হয়রানি বাড়ছে। একটি অসাধু চক্রের এমন কাণ্ডে স্বয়ং হতবাক আইনজীবী থেকে শুরু করে বাদী পর্যন্ত। এসব কাল্পনিক মামলায় বাদী যেমন জানেন না তিনি মামলা করেছেন তেমনি বিবাদীও জানেন না তিনি মামলার আসামি। স্বাক্ষীদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এসব মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাদেরও ঘাম ছুটছে।
এবার জানা গেছে এমন একটি মামলার কথা যেখানে জালিয়াতির মাধ্যমে বাদী হিসেবে নাম ব্যবহার করা হয়েছে একজনের, ছবি অন্যজনের, ফোন নম্বর আরেকজনের। এমনকি বিয়ের কাবিননামাও নকল। নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে এমন জগাখিচুড়ি মামলায় হয়রানির শিকার খোদ বাদী এবং তার পরিবার।
গত ২৩ আগস্ট চট্টগ্রাম সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলাটি হলেও রহস্যজনক কারণে প্রকাশ্যে আসতে একটু সময় লাগে। মামলার বাদী বান্দরবন জেলার আলী কদম উপজেলার ৪নং ওয়ার্ডের চেহের আলীর মেয়ে ইসমত আরা বেগম। তার দাবি, তিনি এ মামলা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার দাবি, এটি একটি কাল্পনিক মামলা। আর্থিক লেনদেন কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য এমন জালিয়াতি মামলা হয়। ভুক্তভোগীর স্বজনদের দাবি আইনজীবীসহ একটি চক্র মামলার কাগজপত্র জালিয়াতি করে মামলার বাদী বানিয়ে হয়রানি করছে। এদিকে, জালিয়াতি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ^াস দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি।
ভুক্তভোগী ইসমত আরা বেগম দৈনিক দেশ বর্তমানকে জানান, আমি একটি এনজিও পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করি। হঠাৎ পুলিশ মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে আমি ভেঙে পড়ি। কারণ আমি খুবই সাধারণ পরিবারের মেয়ে। আমি আমার স্বামীকে নিয়ে বর্তমানে সুখে আছি। এরমধ্যে একটি কুচক্রি মহল আমার কাবিননামা ও টিপসই জালিয়াতি করে আমাকে মামলার বাদি বানিয়ে হয়রানি করছে। যার কারণে আমার পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে গায়েবী মামলার বাদী বানিয়ে দেওয়ায় আমি শ্বশুড় বাড়ির লোকজনের কাছে ছোট হয়ে গেছি। অনেকে মনে করছে এটি আমি করছি, আমার আরেকটা বিয়ে হয়েছে। এরকম বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রে মেয়েরা উপায় না দেখে আত্মহত্যা করে। আইনজীবীদের একটি দুস্কৃতকারী চক্র এটি করেছে। তারা আইনজীবী হয়ে বেআইনি কাজ করছে। চক্রান্তে জড়িতদের মুখোশ উন্মোচন করে তাদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি চাই।
শুধু ইসমত আরা বেগম নয় এর আগেও এমন কাণ্ড ঘটেছে। যেখানে আবু তাহের নামে রিয়াজউদ্দিন বাজারের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে ধর্ষণ মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। মামলায় ভুয়া ভোটার আইডি কার্ড ও মেডিকেল সার্টিফিকেট ব্যবহার করে আইনজীবীদের ছত্রছায়ায় ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪ আদালতে বায়েজিদ থানা এলাকায় ধর্ষণের অভিযোগ আনে তানিয়া আক্তার নামে কথিত এক নারী। মামলার আইনজীবী জি এম জাহেদ হোসেন বাদীর ভুয়া কাগজপত্রে সত্যায়িত করে আদালতে মামলা করতে সহায়তার অভিযোগও আছে। যদিও ওই আইনজীবী জানিয়েছিলেন বাদী তার আত্মীয়সহ এসে কাগজপত্র দিয়ে মামলা করতে অনুরোধ করেছিল। অথচ ভুক্তভোগী আবু তাহের বাদীকে চিনেন না এবং কখনো দেখেননি। তারপরও তাকে মামলায় ফাঁসিয়ে দিনের পর দিন হয়রানি করা হয়। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রো তদন্তে মামলার সাথে বাস্তবতার কোন সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে অব্যাহতি দেন। অব্যাহতি দেওয়ার আগ পর্যন্ত ভুক্তভোগীর নষ্ট হয় অর্থ ও সময়ের।
ইসমত আরা বেগমের স্বজন মো. মোরশেদ দৈনিক দেশ বর্তমানকে বলেন, আমার শালার স্ত্রী ইসমত আরা বেগমের কাবিননামা ও টিপসই জালিয়াতি করে এবং নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে চট্টগ্রাম কোর্টে জনৈক মহিব উল্লাহ নামক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ট্রাইবুনালে মামলা করেছেন। গেল ২৪ সেপ্টেম্বর মামলার ফটোকপি সংগ্রহ করি যেখানে মামলার কপি ও সংযুক্তিগুলো দেখে অবাক হই। মামলার বাদীনীর নাম ও ঠিকানা ইসমত আরার সাথে হুবহু মিল থাকলেও গায়েবী ও মিথ্যা মামলাটি আদালতে ফাইলিং করার সময় বাদিনীর হলফ নামায় দেওয়া হয় ভিন্ন ছবি। বাদীর আইনজীবী সত্যায়িত করা ছবিটি একজন বয়স্ক মহিলার, যার বয়স আনুমানিক ৪০ বছরের কাছাকাছি। ওখানে ইসমত আরার স্বাক্ষর ও টিপসই জাল করে আমাদের অপরিচিত ৩ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান, আইনজীবী আরাফাত হোসেন হীরাসহ ৪ জনের একটি চক্র সংঘবদ্ধ হয়ে এ কাজ করে বলে জানতে পেরেছি। এ ঘটনায় আমাদের পরিবারের চরম মানসম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। অসাধু ও জালিয়াতি চক্রের সাথে জড়িত হয়ে ন্যায় বিচার পাইয়ে দেওয়ার বিপরীতে আর্থিক সুযোগসুবিধা নিয়ে সাধারণ মানুুষকে বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্রকারীদের আইনজীবী সনদ বাতিলের অনুরোধ করছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।
তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সহযোগিতা নিয়ে আগামী সপ্তাহে জড়িত আইনজীবীসহ জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও মানহানির মামলা করবো।
মামলার বাদীর ফোন নম্বর ব্যবহার করা মো. আলাউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি দেশ বর্তমানকে বলেন, আমার নিজস্ব জায়গায় নিয়ে করা মিস মামলা (১০২৭/২৩) চলমান। এই মামলায় এসিল্যান্ড মহোদয় তদন্ত করে সত্যতা পাওয়ায় আমার পক্ষে প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বিরোধী পক্ষের নিযুক্ত আইনজীবী আরাফাত হোসেন হীরার সহযোগিতায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে করা মামলার বাদি ইসমত আরা বেগমের যোগাযোগের নম্বরে আমার নম্বর ব্যবহার করে আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান। যেখানে প্রতিনিয়ত পুলিশের জেরার মুখে পড়ে হয়রানির শিকার হচ্ছি।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ২৩ আগস্ট সকালে হাটহাজারী থানার ফতেয়াবাদ পশ্চিম ছড়ারকুল এলাকার একটি ভাড়া বাসায় যৌতুকের দাবিতে মারধর শিকার হন ভুক্তভোগী ইসমত আরা বেগম। যেখানে স্বামী মুহিব উল্লাহ, মো, ইউসুপ ও আমিন উল্লাহ নামের তিনজনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নং-২ চট্টগ্রাম আদালতে মামলা করেন। মামলাটি হাটহাজারী থানা পুলিশকে এফআইআর করতে আদেশ দেন আদালত। ২৯ আগস্ট এজাহার কলাম পূরণ করে খতিয়ানে নোট করে হাটহাজারী থানা পুলিশ। পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করতে গেলে বাধে বিপত্তি। যেখানে মামলার বাদী নিজেই জানে না মামলার বিষয়টি।
এজাহার সূত্র অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসে কাবিন নামা, মেডিকেল সার্টিফিকেট, টিপসইসহ বিভিন্ন কাগজ জালিয়াতি করে বানানো। অন্যান্য কাগজপত্র বাদির আগের অভিযোগ থেকে সংগ্রহ করা। মামলার প্রতিটি কাগজ সত্যায়িত করেন চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান। যিনি মামলা পরিচালনার দায়িত্বে আছেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হাটহাজারী থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমান বলেন- এটি একটি কাল্পনিক মামলা। বাদী-বিবাদী এবং স্বাক্ষীর কোনো মিল পাচ্ছি না। সাধারণত একটি চক্র আর্থিক সুবিধা কিংবা অসৎ উদ্দেশ্যে এমন মামলা করে লোকজনকে হয়রানি করেন। তদন্ত শেষে মিথ্যা অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।
ইসমত আরা বেগমের আসল কাবিনে আছে স্বামী মো. সাদ্দাম হোসেন। বিয়ের রেজিস্ট্রি তারিখ ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর। বিয়েতে স্বাক্ষী ছিলেন সিরাজুল ইসলাম (বরের উকিল), চেহের আলী (কন্যার উকিল) মেহের আলী ও আব্দু ছালাম বিয়ে পড়িয়েছেন কাজী কুতুব উদ্দিন। কাবিন ৫ লাখ আর উসুল ২ লাখ।
অন্যদিকে জালিয়াতি করে বানানো কাবিননামা আসলটির সাথে কোনো মিল নেই। বানানো কাবিন নামায় দেখা যায়, কনে ইসমত আরা বেগম বর মুহিব উল্লাহ বিয়ের রেজিস্ট্রি তারিখ ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। বিয়েতে স্বাক্ষী দেখানো হয়েছে মো ইউসুপ, রেজাউল করিম, শাহ আলম ও কমরুকে। বিয়ে পড়িয়েছেন মৌলানা আব্দুল করিম। কিন্তু সিল আছে কাজী ফারুক আহমদ চৌধুরীর। কাবিন ৫ লাখের মধ্যে ৪ লাখ উসুল।
জালিয়াতি করা কাগজপত্রে সাক্ষর ও সীল দিয়ে সত্যায়িত করা আইনজীবী মো. মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক দেশ বর্তমানকে বলেন, তাড়াহুড়া করতে গিয়ে এ ভুল হয়েছে। বিষয়টি বেআইনি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর দেননি। তবে ভুক্তভোগীদের তিনি জানিয়েছেন আইনজীবী আরাফাত হোসেন হীরাসহ বিভিন্ন জনের চাপে পড়ে তিনি এটি করেছেন।
মামলার এজাহারে বাদীসহ ৬ জন সাক্ষীর নাম রয়েছে। তারা হলেন- আব্দুল হকের ছেলে মো. করিম, আমীর আলীর ছেলে মো. দিদার, আব্দুল কাদেরের ছেলে মো. জাবিদ ও মৃত বাদশা মিয়ার ছেলে নুরুল আলম। যারা হাটহাজারী থানার ফতেয়াবাদ পশ্চিম ছড়ারকুল এলাকার হায়দার আলী মুন্সির বাড়ির বাসিন্দা।
এমন জালিয়াতিতে আইনজীবীরা জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। তিনি দৈনিক দেশ বর্তমানকে বলেন, একজনের ছবি, অন্যজনের ঠিকানা এবং আরেকজনের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা মানে প্রাথমিকভাবে জালিয়াতির প্রমাণ। এর জন্য ভুক্তভোগী অভিযোগ করলে এর যথাযথ ব্যবস্থা নেব।
এ ঘটনায় আরও আইনজীবী জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারাই জড়িত থাকুক প্রমাণ পেলে কঠিন ব্যবস্থা নেব।
এটাকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে মন্তব্য করে চট্টগ্রাম জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, এই চক্রের জন্য শত শত পরিবার চরম দুর্ভোগের শিকার। চক্রটি এভাবেই বহু মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। এদের কঠিন বিচার হওয়া দরকার।
আইনজীবী জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনজীবী অপরাধ করলে তখনও অপরাধী হিসেবে গণ্য। সুতরাং এই চক্রের সাথে আইনজীবীরা জড়িত থাকলে পুলিশ প্রশাসন তা খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশ করবেন। এটাই আশা করি। ক্রেডিট: দৈনিক দেশ বর্তমান