বাংলাদেশে চালানো এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭০ শতাংশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট- আইআরআইয়ের সেন্টার ফর ইনসাইটস ইন সার্ভে রিসার্চ ওই জরিপ পরিচালনা করে।
গতকাল মঙ্গলবার আইআরআইয়ের ওয়েবসাইটে ‘ন্যাশনাল সার্ভে অব বাংলাদেশ, মার্চ-এপ্রিল ২০২৩’ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলার ১৮ বছর বা তার বেশি পাঁচ হাজার অংশগ্রহণকারীর ওপর ওই জরিপ পরিচালনা করা হয়।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার জনসমর্থন ধরে রেখেছে। তবে বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ২০১৪ সালের পর প্রথমবারের মতো বেশির ভাগ বাংলাদেশি বিশ্বাস করছে, বাংলাদেশ সঠিক পথে নেই।
নির্বাচনী স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা উন্নত হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশিরা ভোট দিতে আগ্রহী।
জরিপের উত্তরদাতাদের ৯২ শতাংশ বলেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাদের ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ৫৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, তারা ‘খুব সম্ভবত’ ভোট দেবে। যারা ভোট দিতে চায় না তারা নির্বাচনী জালিয়াতি এবং ভোটার নিবন্ধন সংক্রান্ত সমস্যাকে ভোটদানের প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৪৪ শতাংশ বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থায় ফেরাকে সমর্থন করে।
তবে তাদের বেশির ভাগই মনে করে, যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন বিরোধীদের এতে অংশ নেওয়া উচিত।
আইআরআইয়ের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক স্টিভ সিমা বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য জনসমর্থন দেখা উৎসাহব্যঞ্জক।
জরিপে একটি প্রশ্ন ছিল, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার কাজকে অংশগ্রহণকারীরা কিভাবে মূল্যায়ন করে। এ ক্ষেত্রে পাঁচটি সম্ভাব্য উত্তর থেকে একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল। ৩০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী শেখ হাসিনার কাজকে ‘খুব ভালো’ বলে মূল্যায়ন করেছে।
৪০ শতাংশ মনে করে, শেখ হাসিনার কাজ ‘মোটামুটি ভালো’। ২০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করে, শেখ হাসিনার কাজ ‘মোটামুটি খারাপ’। ১০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী শেখ হাসিনার কাজকে ‘খুব খারাপ’ বলে মূল্যায়ন করেছে। এ ছাড়া ১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী শেখ হাসিনার কাজ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি বা তারা জানে না।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অংশগ্রহণকারীদের প্রতিক্রিয়া জানানোর হার ছিল ৪৭ শতাংশ। ‘মার্জিন অব এরর’ ধরা হয়েছে প্লাস বা মাইনাস ১.৪ শতাংশ। চার্ট বা গ্রাফগুলোর যোগফল ১০০ শতাংশ না-ও হতে পারে।
জরিপে শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন বৃদ্ধির আভাস থাকলেও দেশ ভুল পথে যাচ্ছে—এমন প্রতিক্রিয়া বেড়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭৬ শতাংশ বলেছিল দেশ সঠিক পথে যাচ্ছে। এ বছরের এপ্রিলে এই হার ৪৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ৫৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করে দেশ সঠিক পথে যাচ্ছে না।
দেশ সঠিক পথে যাচ্ছে এটি মনে করার কারণ হিসেবে ১৯ শতাংশই দেশের সার্বিক উন্নতির কথা বলেছে। ১৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছে জীবনমান উন্নয়নের কথা। ১২ শতাংশ ডিজিটাল বাংলাদেশ (রূপকল্প ২০২১), ১১ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর অর্থনৈতিক উন্নতি ও ৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে দেশ সঠিক পথে যাচ্ছে বলে মনে করে।
দেশ সঠিক পথে নেই—এটি মনে করার পেছনে ৫০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করেছে। ১৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দুর্নীতি বেড়েছে, এমন ভাবনাকে দায়ী করেছে। ৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ‘একপেশে সরকার’ এবং আরো ৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দেশে গণতন্ত্রের অভাবকে দায়ী করেছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২৫ শতাংশ মনে করে, দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুব ভালো। ৩৬ শতাংশ মনে করে, ভালো। ২১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করে, দেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি খারাপ। ১৫ শতাংশ মনে করে, খুব খারাপ।
জরিপে অংশ নেওয়া ৪৫ শতাংশ ব্যক্তি দেশের অর্থনীতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। ওই ৪৫ শতাংশের মধ্যে ১৬ শতাংশ মনে করে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব ভালো। ৩০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ‘খারাপ’ ও ২১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ‘খুব খারাপ’ বলে মন্তব্য করেছে।
৪৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে সন্তোষ ও ৪৭ শতাংশ অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতি নিয়ে অসন্তোষ বৃদ্ধির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে জরিপে।
আগামী বছর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন যাবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে ২৬ শতাংশ ‘ভালো’ বলে মন্তব্য করেছে। ৩২ শতাংশ মনে করে, আগামী বছর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে। ৩৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করে, পরিস্থিতির অবনতি হবে। আগের জরিপগুলোর তুলনায় এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ২০১৯ সালের এপ্রিলের জরিপে ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতা পরবর্তী বছরগুলোতে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকবে বলে আশাবাদী ছিল।
বড় পরিবর্তন এসেছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবনার ক্ষেত্রেও। ২০১৯ সালের এপ্রিলে ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আশাবাদী ছিল। ২০২৩ সালের এপ্রিলে তা ২২ শতাংশে নেমে এসেছে।
এবারের জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা অর্থনীতিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এরপর রয়েছে যথাক্রমে মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। তবে দেশ আগের চেয়ে গণতান্ত্রিক হয়েছে বলে মূল্যায়ন করেছে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা। ২০ শতাংশ উত্তরদাতা রাজনৈতিক মত প্রকাশে পূর্ণ স্বাধীনতা আছে বলে মন্তব্য করেছে। ২৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করে, রাজনৈতিক মত প্রকাশ করা খুব ভয়ের বিষয়।
৫৫ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ না হলেও বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত।