চোখে ঘুম নেই অনেকদিন। রাত নামলেই বুক কাঁপে। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে, হাতে বাঁশের লাঠি কিংবা টর্চলাইট—এই চিত্র এখন চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁওয়ের গ্যারেজ মোড় এলাকার এক কলোনিতে নিয়মিত।
গত শনিবার রাতে এই প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে দেখা যায়—একদল নারী দাঁড়িয়ে আছেন গলির মুখে। কারও চোখে ভয়, কারও মুখে দৃঢ়তা। লাঠি হাতে তাঁরা পাহারা দিচ্ছেন নিজ নিজ ভাড়া বাসা। কারও পেশা গার্মেন্টসকর্মী, কেউ গৃহকর্মী, কেউ দিনমজুরের স্ত্রী। দিনের শ্রম শেষে রাতে আর ঘুম নয়, তাঁদের নিত্যসঙ্গী হলো পাহারা আর উৎকণ্ঠা।
“চাঁদা না দিলে ঘর ছাড়তে হবে”
গত কয়েকদিন ধরে স্থানীয় একদল দুর্বৃত্ত এই কলোনির ভাড়াটিয়াদের কাছে নিয়মিত চাঁদা দাবি করছে। দাবি পূরণ না হলে ঘর দখল, উচ্ছেদ এমনকি খুনের হুমকি দিচ্ছে তারা। অভিযোগ আছে—বাড়ির মালিক আবুল কাশেমের ঘরে থাকা ভাড়াটিয়াদের হুমকি দিয়ে দালাল চক্রটি বাড়িটি হাতিয়ে নিতে চায়।
একাধিক নারী ভাড়াটিয়া বলেন, “দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করি, রাতে এসে একটু ঘুমাতে চাই। কিন্তু এখন রাতে ঘুমিয়ে থাকলে যদি কেউ পেট্রোল ঢেলে দেয়—এই ভয় তাড়ায় না ঘুম, না শান্তি।”
পুলিশ বলছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে
এ বিষয়ে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব উদ্দিন বলেন, “ঘটনার খবর পেয়েই আমরা তাৎক্ষণিক এলাকায় গিয়েছি। যারা বিশৃঙ্খলা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারও অনৈতিক দাবি মেনে চলবে না।”
লড়াই শুধু ঘরের জন্য নয়
এই নারীদের লড়াই কেবল একটি ঘরের চার দেয়ালের জন্য নয়—এই লড়াই বেঁচে থাকার, অধিকার রক্ষার। অনেকেই বলছেন, প্রশাসনের সহায়তা না পেলে হয়তো এই লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যদি প্রতিরোধ না আসে, তাহলে এমন সাহসিকতার পরিণতিও হতে পারে ভয়ানক।
সামাজিক গবেষক তানিয়া ফেরদৌস বলেন, “যেখানে নারীকে ঘরের ভেতর নিরাপদ থাকার কথা, সেখানে তাঁকে যদি লাঠি হাতে পাহারা দিতে হয়—তাহলে সেটি শুধু নিরাপত্তার সংকট নয়, রাষ্ট্রীয় কাঠামোরও ব্যর্থতা।”
নগরবাসীর প্রত্যাশা: রাত যেন নিরাপদ হয়
এই একটি ঘটনা হয়তো শুধু চান্দগাঁওয়ের, কিন্তু এর প্রতিধ্বনি শোনা যায় গোটা শহরে। রাতের চট্টগ্রাম যেন কারও জন্য আতঙ্ক না হয়ে ওঠে, সেই দাবি সকলের।
ভাড়াটিয়া শানু বেগমের কথায়, “আমরা চাই না কেউ লাঠি হাতে রাতে রাস্তায় দাঁড়াক। চাই ঘরে ফিরলে একটু নিরাপদে ঘুমাতে পারি।”
চট্টগ্রামের গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা এই নারীরা যেন আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। রাষ্ট্র যখন ব্যর্থ হয়, মানুষ তখন নিজের হা‘তে দায়িত্ব তুলে নেয়। কিন্তু এ দৃষ্টান্ত যেন বারবার না গড়াতে হয়—এই প্রত্যাশাই রইল।