‘একটা রেফারেন্স দেখান যেখানে উকিলের (আইনজীবীর) সাথে লেগে বাংলাদেশের একটা সাধারণ মানুষ বিচার পেয়েছে। জজের স্বাক্ষর নকল করে আসামি জামিন নিলেও আইনজীবীর সনদ বাতিল হয় না।’ আইনি প্রতিকার চাইতে আসা এক ভুক্তভোগীকে হুঙ্কার দিয়ে এই ঔদ্ধত্যপূূর্ণ মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম জজ কোর্টে কর্মরত আলিমূল এহছান (রাসেল) নামে এক আইনজীবী।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম অফিসের হাতে আসা একটি ভিডিও ক্লিপে ওই আইনজীবীকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘জাস্টিস, যার কথায় মানুষের মরণ কিংবা ফাঁসি হয়, ওনার স্বাক্ষর নকল করে যারা জামিন নিয়েছে তাদের আইনজীবী সনদ বাতিল হয়নি। যা প্রায় সময় খবরের কাগজে লেখা আসে। আইনজীবীর সাথে লাগলে টাকা-পয়সা সব শেষ হওয়ার পাশাপাশি আরও চারটি মিথ্যা মামলা খাবেন।’
এদিকে, এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করা ঠিক হয়নি বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবীর সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক এ এস এম বজলুর রশীদ (মিন্টু)। অভিযোগ করলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান এই দুই আইনজীবী নেতা।
এছাড়া ৩০ মিনিট ২৭ সেকেন্ডে আরেক ভিডিওর বিভিন্ন পয়েন্টে আইনজীবী রাসেলকে বলতে দেখা যায়, ‘আমার সাথে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের এই চুক্তির প্রজেক্ট ছাড়াও আরও ৫ প্রজেক্ট রয়েছে। যা ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে। মূলত এরাই এসব কাজ করে আমি তাদেও নিযুক্ত উকিল মাত্র’।
জানা যায়, চট্টগ্রাম কোর্টহিলের দোয়েল ভবনের ৪র্থ তলার ৪০৮ নম্বর নিজের ব্যক্তিগত চেম্বারে বসে আইনজীবী পেশার আড়ালে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজসে নগরীর অক্সিজেন এলাকার আলাউদ্দিন নামের এক ভুক্তভোগীর জায়গা নিজেরা ডেভলপার না হয়েও ডেভলমেন্ট করার চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী সহযোগিতা না করে উল্টো আইনজীবী ও চক্রটি তাঁর চেম্বারে ভুক্তভোগীর শত্রুপক্ষ মঞ্জুর আলম নামে একজনের সাথে ১০ লাখ টাকা বিনিময়ে সাদা কাগজে চুক্তি করেন। যেখানে ভুক্তভোগীর বিপক্ষে লেলিয়ে দেয়ার জন্য ১ লাখ টাকা নগদ পরিশোধ করে। কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া ও টাকা দেওয়ার ভিডিও সংরক্ষিত আছে।
ভিডিওতে অভিযুক্ত আলিমূল এহছান রাসেল এবং জাফরুল আলম নামের আরেক আইনজীবীর স্বাক্ষরও রয়েছে। এভাবে টাকা দেওয়ায় শত্রুপক্ষ ভুক্তভোগীর বাসা ও তাঁর স্ত্রীর ওপর হামলা করে প্রাণ নাশের হুমকি দেন। যা ওই সময় বায়েজিদ থানায় মামলা দায়ের হয়। এমনকি হামলার বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকায় গুরুত্বের সহিত সংবাদও প্রকাশিত হয়। ঘটনার বেশ কিছুদিন পর গত ৯ নভেম্বর রাতে নগরীর একটি রেস্টুরেন্টে এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে দুই পক্ষের মতের অমিল ও শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় জায়গার মূল দলিল ফেরতসহ চুক্তিপত্র বাতিল করার সম্মতি দিয়েও চক্রটি উল্টে যায়। পরে তাদের কথা না শুনলে চক্রটির সাথে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে গুম এবং মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন বলে জানান ভুক্তভোগী আলাউদ্দিন। যা ভিডিও ক্লিপেও বলতে শোনা যায়।
তবে এই আইনজীবীর অনেকগুলো ভিডিও ক্লিপ চট্টগ্রাম অফিসে সংরক্ষিত আছে। সেসব ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, কখনো আইনজীবীকে কটাক্ষ, কখনো সাংবাদিক, আবার কখনো পুলিশ কর্মকর্তাদের কটাক্ষ করে কথা বলছেন তিনি। এছাড়াও ভুক্তভোগীর সাথে সিএমপির কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার ফোন কল রের্কডে তাদের পরোক্ষভাবে এই চুক্তির সাথে জড়িত থাকার প্রমাণও মেলে বলে দাবী ভুক্তভোগীর।
বিষয়টি সরেজমিনে জানতে গেল বৃহস্পতিবার বিকালে ওই আইনজীবীর চেম্বারে গেলে বন্ধ থাকায় সরাসরি কোন বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তবে তিনি শুক্রবার দুপুরে মুঠোফোনে ভিডিওতে দেওয়া বক্তব্যগুলো তার এবং তিনি এ কথাগুলো কথা প্রসঙ্গে বলেন বলে দাবি করেন। ডেভেলপমেন্টের জন্য নয়, নিজেদের আবাসনের জন্য চুক্তি করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, নিজেদের কষ্টের টাকা দিয়ে চুক্তি করেছি। কিন্তু জায়গাটি আগে বিক্রি হয়েছে সেটা জানতাম না।
এ সময় ভূমি অফিস ভুক্তভোগীর পক্ষে রায় দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমার চেম্বারে এসে আমাকে ভিডিও করে আমার সাথে প্রতারণার চেষ্টা করছেন তারা। যদিও বেশীরভাগ ভিডিও বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট করা। ভুক্তভোগী চুক্তি বাতিল করতে চাইলে আপত্তি নেই বলেও জানান এই আইনজীবী।
এদিকে প্রতিকার পেতে ভুক্তভোগী আলাউদ্দিন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের শরানাপন্ন হবেন বলে জানান।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবীর সমিতির সভাপতি মো. নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ভিডিওতে যা দেখছি তা একজন আইনজীবী হিসাবে এভাবে বলা ঠিক হয়নি। কারণ সংবিধানে সকল নাগরিকের অধিকার সমান। ওখানে কে আইনজীবী, কে পুলিশ কিংবা, কে সাধারণ মানুষ তা বিশেষভাবে উল্লেখ নেই। এমনকি আইনজীবীও আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অভিযুক্ত আইনজীবীকে নিয়ে সমিতিতে বিচার দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান তিনি।
একই বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবীর সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ এস এম বজলুর রশীদ (মিন্টু) বলেন, অতীতে যে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে এবং তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেছে তাদের সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে। এই অভিযুক্ত আইনজীবীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না।
আইনজীবী হয়ে ডেভলপারের ব্যবসায় জড়িত থাকার বিষয়ে বিষ্ময় প্রকাশ কর তিনি বলেন, এখানে অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রমাণিত হলে অভিযোগের ভিত্তিতে সমিতির আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২৫ শে জানুয়ারি অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার নামা ও একই তারিখে ভূমি উন্নয়ন ও হস্তান্তরের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন করে উভয় পক্ষ। যেখানে নুর ইসলাম নামে এক ফল ব্যবসায়ীকে পার্টনার করা হয়। চুক্তি নামা করার সময় উপস্থিত ছিলেন সিএমপির বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা।