জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধন ও এ সংক্রান্ত সেবা নির্বাচন কমিশনের হাত থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিতে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন বিল-২০২৩’ সংসদে বিল পাস হয়েছে।
বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিলটি পাসের জন্য সংসদে উত্থাপন করেন। বিলের ওপর আনা জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি শেষে কন্ঠভোটে বিলটি পাস হয়।
২০১০ সালের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন বাতিল করে নতুন আইন করতে বিলটি পাস করা হয়েছে।
বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দলীয় সদস্যরা অভিযোগ করেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে। কারণ পুলিশ এখনও জনবান্ধব হতে পারেনি। পুলিশের সমালোচনা করতে গিয়ে বিরোধী দলীয় সদস্যরা সম্প্রতি পরকীয়া প্রেমের জের ধরে পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতন এবং আদালত চত্ত্বরে আইনজীবীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনাও উল্লেখ করেন।
এসব সমালোচনার জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামাক খাঁন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় যেই অপরাধ করুক শাস্তি কিন্তু পেতে হয়। আপনারা যে পুলিশ অফিসারের কথা বলেছেন তিনিও আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তাকে ইমিডিয়েট যে ব্যবস্থা সেটা নেয়া হয়েছে। এখন তার শাস্তির ব্যবস্থাটা… যেহেতু মামলা হয়নি। এখনো কেউ মামলা করেনি। আমাদের তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী তার শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই হবে।’
এর আগে বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে গণফোরাম সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, এনআইডি নিয়ে মানুষের অনেক ভোগান্তি রয়েছে। এটা নিয়ে মানুষের অনেক সমস্যা আছে। এটা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে গেলে দুর্ভোগ আরও বাড়বে। কারণ এখনো পুলিশ প্রকৃত পক্ষে জনগণের বন্ধু হতে পারেনি।
জন্মের পরেই নাগরিকত্ব আইডি দেওয়ার বিষয়ে মোকাব্বির খান বলেন, জন্ম নিবন্ধনতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করে না। এটি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তাহলে সেটা কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন। এটি করতে গেলে জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বেশ কয়েকটি কর্তৃপক্ষকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসতে হবে।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, ইসির কাছে থাকা নাগরিকের তথ্য যাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। কিন্তু ইসির সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। ভোটার তালিকা করার স্বাধীনতা ইসির। নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল হবে। এর আগে এই আইনটি কার্যকর হলে ভোটার তালিকা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও পুলিশের সংঘর্ষের কথা তুলে ধরে জাতীয় পার্টির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, আইনজীবীদের পেটাতে দেখা গেছে। তাদের অপরাধ জানা যায়নি। তারা সরকার বিরোধী হতে পারেন। আইনজীবীদের গায়ে হাত তোলার বিষয়ে সরকারের সতর্ক থাকা উচিত।
তিনি বলেন, পুলিশকে ওই কৌশলটা বের করতে হবে। কীভাবে চাপ না দিয়েও পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়, পরিস্থিতি শান্ত করা যায়।
আইনজীবীর গায়ে হাত তোলা গর্হিত কাজ এমন মন্তব্য করে শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, পুলিশকে একসময় আইনজীবীর মাধ্যমে ন্যায় বিচার চাইতে হবে, তাই তাদের সম্মান জানানো উচিত।
ছাত্রলীগ নেতাদের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ টেনে জাতীয় পার্টির আরেক সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ঢাকায় যেসব পুলিশ কর্মকর্তার পদায়ন করা হয় তাদের বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেওয়া হয়। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে যারা অনুগত তাদের ঢাকায় পদায়ন করা হয়। তারপরেও এমন কর্মকর্তা ঢাকায় কীভাবে আসে? হিন্দি সিনেমার মত কোন এক কর্মকর্তা তার অবৈধ প্রেমের কারণে ছাত্রলীগের নেতাদের থানায় পুলিশের কন্ট্রোল রুমে নিয়ে সাতআটজনে মিলে অমানুষিকভাবে নির্যাতন করে। এটা সিনেমাকে হার মানিয়েছে। এটা অত্যন্ত জঘন্য ঘটনা।
তিনি বলেন, পুলিশের হেফাজতে নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিককে নির্যাতন করে, তাও সরকার দলের সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের নির্যাতন করে তাহলে দেশের আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি অবস্থাটা কি? আমি জানি না কেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মামলা করে নাই। শুধু তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিলে সুবিচার হবে না। সুবিচার হবে ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করে ফৌজদারি আইনের আওতায় এনে বিচার করে সাজার ব্যবস্থা করেন। যাতে এ ধরণের উচ্ছৃঙ্খল পুলিশ অফিসার ক্ষমতার অন্ধ হয়ে, রাষ্ট্রের বেতন নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করবে এটা অন্তত বন্ধ করেন।
পাস হওয়া বিলে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য একজন ‘নিবন্ধক’ থাকবেন। সরকার তাকে নিয়োগ দেবে। নিবন্ধক ও নিবন্ধকের কার্যালয়ের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে শুরু না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে পারবে। সরকার গেজেট জারি করে যে তারিখ নির্ধারণ করবে সে তারিখ থেকে এই আইন কার্যকর হবে।
বিদ্যমান পরিস্থিততে এনআইডি দিয়ে থাকে নির্বাচন কমিশন। নতুন আইনটি কার্যকর হলে ইসি সে ক্ষমতা হারাবে। বিলে বলা হয়েছে, বিদ্যমান আইনটি রহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কাছে রক্ষিত এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সংগৃহীত জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সকল তথ্য–উপাত্তের কপি এবং সম্পদ ও দায় দেনা নিবন্ধকের কাছে কাছে হস্তান্তরিত হবে।
বিলে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের চাহিদা মোতাবেক নিবন্ধক প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত প্রদান করবে। এজন্য নিবন্ধকের কার্যালয়ের অধীন একটি সেল থাকবে। এই সেলে নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মচারি দায়িত্ব পালন করবেন।
বিলে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার জন প্রত্যেক নাগরকিকে পরিচয় নিবন্ধন করতে হবে। এ জন্য নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিবন্ধকের কাছে আবেদন করতে হবে। একজন নাগরিককে নিবন্ধক একটি নাম্বার দেবেন। সেটা একক পরিচিতি নাম্বার (ইউনিক আইডেনটিফিকেশন নাম্বার) হিসেবে সবখানে ব্যবহৃত হবে।
বিলে বলা হয়েছে, নিবন্ধন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, সমন্বয় ও পরিবীক্ষণের জন্য একটি সমন্বয় কমিটি থাকবে। এই কমিটির সভাপতি হবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব। নিবন্ধক হবেন এই কমিটির সদস্য সচিব। নির্বাচন কমিশন ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিরা থাকবেন সদস্য।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিভিন্ন দেশের উদাহরণের আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সুরক্ষা সেবা বিভাগ এই দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ। তাই সুরক্ষা সেবা বিভাগের মাধ্যমে এই সেবাটি জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন।