বিশ্বে সামরিক সংঘাতের ইতিহাসে ড্রোনের সবচেয়ে নিবিড় ব্যবহার হচ্ছে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে। একে আধুনিক যুদ্ধকৌশল ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের মাইলফলক বলছেন সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ড্রোন কি নতুন কোনো আবিষ্কার? ড্রোন দীর্ঘকাল ধরেই আছে। চীনের ‘ফায়ার কাইট’ বা আগুনের ঘুড়ি এর পূর্বসংস্করণ।
অথবা ১৮৪৯ সালে ভেনিসে অস্ট্রিয়ার বেলুন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আক্রমণের ইতিহাস তৈরি হয়। এতে বোঝা যায়, ড্রোনজাতীয় সরঞ্জাম ব্যবহার অনেক পুরনো। ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে ভিয়েতনামে, কসোভো যুদ্ধে, আফগানিস্তানে, ইরাকে এবং অতি সম্প্রতি আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘর্ষে নাগর্নো-কারাবাখে।
যুদ্ধে বাঁকবদলের মাইলফলক এসব বিবেচনায় নিলে বলা যায়, ইউক্রেনের যুদ্ধ ‘প্রথম ড্রোনযুদ্ধ’ নয়।
ড্রোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বা উভয় পক্ষ ব্যবহার করছে—এসব বিবেচনায়ও এটি প্রথম যুদ্ধ নয়। তবু ইউক্রেনে ড্রোনের ব্যবহার একটি পরিবর্তনের মাইলফলক হিসেবে থাকবে। সামরিক সংঘর্ষে এত ড্রোন আগে কখনো ব্যবহার করা হয়নি। রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের ধারণা, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেন প্রতি মাসে ১০ হাজার ড্রোন হারাচ্ছে।
এ থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কত ড্রোন ইউক্রেন এখন ব্যবহার করছে। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত মনুষ্যবাহী বিমান দিয়ে আক্রমণ বন্ধ করেছে। এটি মনুষ্যবিহীন প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। যারা এর গুরুত্ব বুঝতে চায়, তাদের জন্য ইউক্রেনের কাছ থেকে শেখার কিছু বিষয় আছে।
ইউক্রেন অনেক ধরনের ড্রোনব্যবস্থা কাজে লাগাচ্ছে
ইউক্রেন যে ড্রোনগুলো ব্যবহার করছে, সেগুলো খুব স্বল্পপাল্লার।
যেমন ব্ল্যাক হর্নেট। এর ডানা মাত্র ১২ সেন্টিমিটার থেকে ১৫ মিটার বিস্তৃত। ছোট এই ড্রোনগুলো ইউক্রেনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোয়াডকপ্টার এবং অন্য রটার ড্রোনগুলো মূলত চীনা ডিজেআইয়ের মতো বাণিজ্যিক সংস্থার তৈরি। এগুলো একেবারেই সাধারণ মানের।
তুরস্কের নির্মিত বায়রক্তার টিবি২ বা রাশিয়ার ওরিয়ন ড্রোন সশস্ত্র সরঞ্জাম, ক্ষেপণাস্ত্রও বহনে সক্ষম। এসব ড্রোন মাটিতে সেনাদের আক্রমণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তথাকথিত কামিকাজে ড্রোনের মতো একবার ব্যবহার উপযোগী ড্রোনগুলো বিস্ফোরণ ঘটানোর আগে লক্ষ্যবস্তুর ওপর ঘোরাফেরা করে। রাশিয়া এগুলো ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু সম্প্রতি মস্কোতে হামলার জন্য এ ধরনের ড্রোন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। সর্বশেষ গতকালও মস্কোতে ড্রোন হামলা হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, প্রচার ও হামলার জন্য ড্রোনের ব্যবহার
ড্রোনের সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যবহার হলো নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ। সব ধরনের ড্রোনই ফটো, ভিডিও বা অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সেন্সর বহন করে। সেগুলো শত্রুঘাঁটি শনাক্ত, সেনাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং লক্ষ্যবস্তু বেছে নিতে পারে। এই ড্রোনগুলো নজরদারির পাশাপাশি খুব কাছ থেকে হামলার দৃশ্য ধারণেরও ক্ষমতা রাখে। ড্রোনগুলো হামলার আগে রেকি করার মতো প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করতে পারে। এসব ড্রোন রুশ বাহিনীর শহর ধ্বংস, কাখোভকা বাঁধ ধ্বংসের পর ইউক্রেন ভূখণ্ডে বন্যা এবং রুশ জাহাজ, ট্যাংক, সেনা ও সরঞ্জামের ওপর হামলার তথ্য-উপাত্ত ধারণ করেছে।
সরাসরি সাহায্যের জন্য এবং হামলা পরিচালনায় ড্রোনগুলোকে ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধের শুরুতে কিয়েভের দিকে রওনা হওয়া রাশিয়ার সামরিক বহরকে লক্ষ্য করেই ইউক্রেনীয় বাহিনী টিবি২ (তুরস্কের বায়রাক্তার) এর মতো সশস্ত্র সামরিক ড্রোন ব্যবহার করে।
রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ মসকোভায় নৌবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ এবং শেষ পর্যন্ত এটিকে ডুবিয়ে দেওয়ার সময় ওই জাহাজটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করতে সম্ভবত একটি টিবি২ ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল। ড্রোনের মাধ্যমে সংগৃহীত গোয়েন্দা তথ্য কামান দিয়ে এবং অন্যান্য উপায়ে হামলার নির্দেশ দিতেও ব্যবহৃত হয়।
ইউক্রেন যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক বেসামরিক ড্রোন
ইউক্রেনীয় বাহিনী যে ড্রোনগুলো ব্যবহার করছে, সম্ভবত সেগুলোর বেশির ভাগেরই নকশা মূলত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বা শখ মেটাতে করা হয়েছিল। এগুলোর ব্যবহার সহজ। দাম কম। পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে। ওই ড্রোনগুলো যুদ্ধের জন্য তৈরি করা হয়নি। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে সেগুলো দীর্ঘ সময় টেকে না। তবে দাম ও প্রাপ্যতার কারণে এগুলো সাধারণত সরবরাহযোগ্য। এই ড্রোনগুলোর বেশির ভাগের নির্মাতা চীনের ডিজেআই।
যুদ্ধ শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ডিজেআই ইউক্রেন ও রাশিয়ায় তার কার্যক্রম স্থগিত করে। তবে তাদের ‘ম্যাভিক’ ধরনের ড্রোনগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে এই যুদ্ধে। চাহিদার তালিকায়ও ওই ড্রোন আছে। ব্যক্তিবিশেষরা অনেক ড্রোন কিনে ইউক্রেন সামরিক বাহিনীকে সরবরাহ করেছে। এ ছাড়া জনগণের কাছ থেকেও হাজার হাজার ড্রোন অধিগ্রহণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
মস্কোতে ড্রোন হামলা সামরিক পরিণতি ডেকে আনতে পারে
ইউক্রেন সরকার এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে মস্কোতে ড্রোন হামলার দায় স্বীকার করেনি। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে মস্কোতে ড্রোন হামলা বাড়ছে। প্রাথমিকভাবে গত ডিসেম্বরে এঙ্গেলস বিমান ঘাঁটির মতো রাশিয়ার সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ করার জন্য মনুষ্যবিহীন সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছিল। অতি সম্প্রতি মস্কোর অর্থনৈতিক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থানে ড্রোন হামলা হয়েছে। এ হামলা সম্ভবত ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী বা রাশিয়ার ভেতর থেকে ইউক্রেনপন্থী গোষ্ঠীগুলো করেছে। এসব হামলার সামরিক প্রভাব সীমিত। এখন পর্যন্ত হামলায় কেউ নিহত হয়নি। ধ্বংসের পরিমাণও কম বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এগুলো রাশিয়ার শাসক, জনগণ ও ব্যবসায়ী মহল বার্তা দিচ্ছে যে যুদ্ধ রাশিয়ায়ই ফিরে আসতে পারে।
রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিছু ড্রোন আকাশেই ধ্বংস করতে পারছে বলে খবর পাওয়া যায়। কিন্তু রাশিয়ার সামরিক বাহিনী যে তাদের রাজধানীকে ড্রোন হামলা থেকে রক্ষায় পুরোপুরি সক্ষম নয়, এটিও এখন তাদের জন্য বিব্রতকর।
যদি আক্রমণ অব্যাহত থাকে এবং এর মাত্রা ও শক্তি বাড়ে, তাহলে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে মস্কো ও অন্য শহরগুলোর সুরক্ষা বাড়াতে হতে পারে। এর অর্থ, রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা বিশেষজ্ঞদের যুদ্ধের সম্মুখসারি থেকে প্রত্যাহার করতে হতে পারে।
ড্রোন সহজ লক্ষ্যবস্তু হলেও যুদ্ধ সহজ নয়
এসব ড্রোন লক্ষ্যবস্তু হিসেবে সাধারণ। কারণ এগুলো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়াতে তৈরি করা হয়নি। তারা কম উচ্চতায় ও ধীরে ধীরে উড়তে থাকে। ড্রোন প্রায় এক আঘাতেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তবে ড্রোনের সঙ্গে লড়াই করা কঠিন। এটা করতে হলে ঠিক জায়গায়, সঠিক সময়ে সঠিক ড্রোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা দরকার। এখনো কোনো দেশে ড্রোনের দামের চেয়ে ড্রোনের সঙ্গে লড়াই করার জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করা হয় না।
ড্রোন আকাশ থেকে নামিয়ে আনার দুটি উপায় আছে। একটি গতির সাহায্যে এবং বৈদ্যুতিকভাবে। প্রথমটি গুলি করে কিংবা রকেট বা অনুরূপ একটি ড্রোন দিয়ে আঘাত করে ড্রোনকে মাটিতে নামানো। ইউক্রেন আকাশ থেকে আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গেপার্ডস সিস্টেম, প্যাট্রিয়টস বা আইরিস-টি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে।
ড্রোন নামিয়ে আনার দ্বিতীয় ব্যবস্থাটি হলো ড্রোন এবং তা পরিচালনাকারীর মধ্যে সংকেত চলাচলে জ্যাম সৃষ্টি করা বা বাধা দেওয়া। এই পদ্ধতির একটি আরো উন্নত সংস্করণ হচ্ছে ড্রোন হ্যাক করা এবং এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া। এ ছাড়া ড্রোন আটকানোর জাল বা নেট থ্রোয়ার, ড্রোনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ড্রোন, এমনকি ড্রোন শিকারি প্রশিক্ষিত পাখিরাও অনাকাঙ্ক্ষিত বা শত্রুপক্ষের ড্রোন আটকাতে পারে। ড্রোন ঠেকানোর উদ্যোগ এখন কয়েক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
ইউক্রেনে নৌ ড্রোন ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে
ড্রোন বলতে এখন আর বায়ুবাহিত কোনো ব্যবস্থাকে বোঝায় না। স্থলভিত্তিক ড্রোনের পাশাপাশি সামুদ্রিক ড্রোনও আছে। সেগুলো জাহাজের উপরিভাগে ও সাবমেরিনের মতো কাজ করতে সক্ষম। অনেকে একে ড্রোন না বলে রোবটও বলে থাকেন।
ইউক্রেন যুদ্ধের আগে সামরিক অভিযানে শুধু বায়ুবাহিত ব্যবস্থার ড্রোন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। এখন পরিবর্তন শুরু হয়েছে। গত শরতে ড্রোন-বোট ব্যবহার করা হয়েছিল। সেভাস্তোপলে রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগর ফ্লিটে আক্রমণে ড্রোন-বোটের ব্যবহার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। অতি সম্প্রতি ইউক্রেনীয় বাহিনী নৌ ড্রোন ব্যবহার করে একটি রুশ জ্বালানি ট্যাংকারকে আঘাত করেছে এবং রাশিয়ার একটি উভচর ল্যান্ডিং জাহাজের ক্ষতিসাধন করেছে। এই আক্রমণগুলো ইউক্রেনের উদ্ভাবনী সামরিক শিল্প খাতের নিদর্শন।
যুদ্ধ শেষ হলে ইউক্রেন সম্ভবত ড্রোনশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠবে
এই যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন ড্রোন উন্নয়ন ও উৎপাদনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে উঠেছে। তারা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য ড্রোনের উন্নয়ন বা পুনর্নির্মাণে কাজ করছে। যুদ্ধের চাপে উদ্ভাবনের প্রয়োজন, ইউক্রেনীয় জনগণের উদ্ভাবন দক্ষতা এবং অনেক পশ্চিমা দেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজের সুযোগ ইউক্রেনকে একটি শক্তিশালী দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্পের ভিত্তি স্থাপনে সহায়তা করেছে।
তাই বলা যায়, যুদ্ধ যখন শেষ হবে, তখন ইউক্রেনের ড্রোনশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক শক্তি হয়ে ওঠার পথে রয়েছে। এই যুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত ড্রোনব্যবস্থা রপ্তানি করতে সক্ষম হবে ইউক্রেন।
ড. উলরিক ফ্রাংকো : নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র ফেলো এবং জার্মানির পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি, প্রযুক্তি, ভূ-রাজনীতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সামরিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।